উচ্চশিক্ষায় জাপানের এগিয়ে যাবার রহস্য
প্রাচ্যের সমৃদ্ধশালী কয়েকটি দেশের মধ্যে জাপান অন্যতম। তাঁদের সমৃদ্ধি শুধু অর্থনীতি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং শিক্ষাক্ষেত্রেও ঘটিয়েছে ব্যাপক বিস্তৃতি। জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা হিসেবে গন্য করা হয়। এলিমেন্টারি স্কুল থেকে শিশুদের এমনভাবে তৈরি করা হয়, যেন ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার পথ সহজ হয়ে যায়। তাই তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বদাই বৈচিত্র্যের আভাস পাওয়া যায়।
জাপানের একটি চমৎকার বিষয় হচ্ছে, তারা পাঠ্যবইয়ের শিক্ষার চেয়ে জীবনমুখী শিক্ষাকে বেশি প্রাধন্য দেয়। কিন্ডারগার্ডেনে পড়া শিশুরা কোনো পাঠ্যবই নয়, তারা পরিচিত হয় ফুল, পাখি, প্রকৃতির সাথে। আচার ব্যবহার, হাঁটা-চলা, নীতি-নৈতিকতা, সামাজিকতা, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি তাদের শিক্ষার মূল বিষয়। যা তাদের প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে। এলিমেন্টারির (ক্লাস ১-৬) শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বলতে কিন্ডারগার্ডেনে প্রাপ্ত শিক্ষা থেকে আর একটু বাড়তি কিছু শেখানো হয়। পাশাপাশি ওদের বর্ণমালা, খেলাধুলার কসরত, গনিতের কিছু সাধারন সমস্যা সমাধান, ট্রাফিক নিয়ম-কানুন প্রভৃতি শেখানো হয়। এগুলো তারা চাপে পড়ে নয়, বরং আনন্দের সাথে গ্রহন করে। তাদের পরীক্ষা বলতে কিছু নেই। জীবনের প্রতিটা সমস্যার সুন্দরভাবে সমাধান করাই তাদের মূল পরীক্ষা।
তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাদের কি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের প্রয়োজন হয় না? উত্তর হলো- হ্যাঁ, অবশ্যই প্রয়োজন হয়। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতি এমন, যেন একজন শিক্ষার্থী সুশিক্ষার পাশাপাশি স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠে। মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি রয়েছেঃ জাপানী সামাজিক গবেষণা, গণিত বিজ্ঞান, সঙ্গীত কলা, শারীরিক শিক্ষা, শিল্পকৌশল শিল্প এবং হস্তশিল্প। প্রাইভেট স্কুল পরীক্ষার শর্তাবলী অনুযায়ী প্রতিটি স্কুল পরীক্ষার পদ্ধতি বা অন্যান্য কাজ নির্ধারিত থাকে। জাপানিদের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের তত্ত্বীয় বিষয়গুলো স্কুলে এবং প্রযুক্তির বিষয় কলেজে প্রদান করা হয়। প্রকৌশল, ব্যবসায় এবং কৃষি ব্যবসা সম্পর্কিত কোর্স প্রদানে প্রায় ৪৬০টি উচ্চ মাধ্যমিক বিশেষ প্রশিক্ষণ স্কুল আছে। তারা ২ বছর এর মধ্যে এই কোর্স শেষ করে । বিশেষ প্রশিক্ষণ কলেজ যেমন, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রযুক্তিগত দক্ষতার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। বর্তমানে জাপানে ৭৮২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তন্মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৮৬টি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৯৬টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৬০০টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সময়কাল সাধারণত ৪ বছর এবং বিশেষ ক্ষেত্রে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার জন্য সাধারণত ৪ বছরেরবেশি সময় লাগতে পারে, যেমন- ব্যাচেলর অব নার্সিং বা ব্যাচেলর অব এডুকেশন।
জাপানি শিক্ষকদের মূল লক্ষ্য ছাত্রছাত্রীদের এমনভাবে নির্দেশনা দেয়া যেন এলিমেন্টারি পর্যায় শেষ করেই তারা জীবনের একটা লক্ষ খুজে পায় যে, ভবিষ্যতে কোন বিষয় নিয়ে পড়া তাদের জন্য উপযুক্ত হবে। এর ফলে তাদের মুক্ত চিন্তাভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হবে। একটি চারা কে পরিচর্যা করলে যেমন ডালপালা বিস্তৃত মহীরুহ হয়ে উঠে, তেমনি একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পরিচর্যা করলে সময়ের সাথে জ্ঞানের পরিধিও প্রসারিত হবে। জাপানীরা এই নীতি অনুসরন করে চলে বিধায় তাদের শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন সবার জন্য অনুসরনীয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতিতে জাপানীদের ভূমিকা অতুলনীয়। প্রযুক্তির এই অগ্রযাত্রা তাদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষা বলতে ওদের শুধু আর্টস, কমার্স বা সায়েন্স নয়, তার চেয়েও অনেক বেশী কিছু বোঝানো হয়। জাপানীরা প্রতিনিয়ত নিজেদের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গী ও অনন্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অসম্ভবকে জয় করে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। তারা শিক্ষাকে যেমন দৈনন্দিন কার্য তালিকার অংশ হিসেবে মনে করে তেমনি কাজকেও একই মাপকাঠিতে বিবেচনা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধস্ত জাপানকে এগিয়ে নিতে শিক্ষা প্রধান দূত হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। সমৃদ্ধ গবেষণার বিবেচনায় জাপানের শিক্ষার গুণগত মান কখনও কখনও পশ্চিমা বিশ্বকেও ছাড়িয়ে যায়।
প্রিয় পাঠক, এখন আপনাদের মনে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে – “আমাদের বাচ্চারা তো খুব বই পড়ছে, তবে কি তারা শিক্ষিত হচ্ছে না”? আসলে পাঠ্যবইয়ের শিক্ষা তো প্রায় ক্ষেত্রে পরীক্ষার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু একজন সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে উঠার জন্য বাস্তব শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শিক্ষার মাঝে তখনই উৎসাহ আর সৃজনশীলতার দেখা মিলবে যখন সে বাস্তবে তা উপলব্ধি বা অনুধাবন করতে পারবে। কারন, উৎসাহ না পেলে শেখার আগ্রহ কখনই প্রকাশ পায় না। এই “উপলব্ধি” বিষয়টির কারনেই মূলত জাপান উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে থাকবে।
Writer,
Somaiya Afrin Eva Khondokar
Intern, Content Writing Department
Requin BD
1 Comments
Suriya
March 27, 2023
very informative