বিষের জাদুমানবী তোফানা

বিষ, এমন একটি মারণাস্ত্র যার শরীরে প্রবেশ যেকোনো মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে দাঁড় করায়। এমন মানুষকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে বিষের স্বাদ পরীক্ষা করতে চাইবে। তাই ভাবতে পারেন, কে এই বিষের আবিষ্কারক এবং কী ভেবে কেউ এই ভয়ংকর জিনিস আবিষ্কার করেছিল? এই আবিষ্কার হাজারো মানুষের হত্যাক্রিয়া চালনা সহজ করে দিয়েছিল।

গিউলিয়া তোফানা নামের এক নারী, যে ভয়ংকর বিষ ‘একুয়া তোফানা’ আবিষ্কার করেছিলেন। তাই বিষের নামকরন তার নামের সাথেই মিল রেখে করা হয়েছে। গিউলিয়াকে ইতিহাসের অন্যতম মারাত্নক লেডি সিরিয়াল কিলার বলা হয়, যদিও বেশি তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়নি। যতটুকু জানা যায়, তিনি ইতালির পালেরমো শহরের অধিবাসী ছিলেন। তার একটি মেয়ে ছিল, তবে এই মেয়েটির ব্যাপারে আর কিছু জানা যায়নি। তার জীবনকাল ধারনা করা হয় আনুমানিক ১৬২০-১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। তার তৈরিকৃত বিষে প্রায় ৬০০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তবুও তাকে মানুষ কিংবদন্তী হিসেবে মনে করে। মানুষ তার হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে, কারন তারা মনে করে এ হত্যাগুলো যৌক্তিক ছিল। সে হত্যা করত একটি নির্দিষ্ট শ্রেনির মানুষকে, যাদেরকে সে বেঁচে থাকার অযোগ্য মনে করত।

একুয়া তোফানা এতটাই ভয়ংকর বিষ ছিল যে, মৃত্যুর পর মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করেও শনাক্ত করা যেত না। শরীরের সাথে পুরোপুরি মিশে যেত। বিষক্রিয়া ঘটত খুব ধীর গতিতে, ফলে হত্যাকান্ডের পরিবর্তে ডাক্তাররা কোনো অজানা রোগ মনে হতো। এই বিষ এতই সাংঘাতিক ছিল যে, চারফোঁটা ব্যবহারই যথেষ্ট একজনের মৃত্যুপরোয়ানা জারির জন্য! বিষটি তৈরির প্রধান উপকরন ছিল– আর্সেনিক, লেড বেলাডোনা, যারা নিজেরাই এক একটা বিষ। তিন পদার্থের মিশ্রনে বিষ তৈরি নিয়েও গুজব আছে। ধারনা করা হয়, কুখ্যাত থোফানিয়া ডিঅ্যামাডো মৃত্যুর আগে তার মেয়ে গিউলিয়ার কাছে বিষ তৈরির রহস্য জানিয়েছিলেন। তার মা কে ১৬৩৩ সালে নিজের স্বামীকে হত্যা করার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যদি ঘটনা এমন না ও হয়, তাও বলা যায় গিউলিয়া নিজেই তৈরি করেছিলেন। কারন, তিনি সব ধরনের টিংচার তৈরিতে ছিলেন সুদক্ষ। সে সময় আরও বিষ পাওয়া যেত, যার মধ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত ছিল হেমলক, কান্তারেলা, আর্সেনিক, ফক্সগোভ, স্ট্রিকিনিন। পরবর্তীতে একুয়া তোফানার কার্যক্রম সর্বাধিক ব্যবহার্য লিষ্টের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

গিউলিয়া এই বিষগুলো কাদের বিক্রি করতেন? আসলে, তার কিছু নিদিষ্ট ক্রেতা ছিল এবং তিনি ভিন্ন কৌশলের মার্কেটিং অবলম্বন করত। তার মূল ক্রেতা ছিল দুর্ভাগ্যের শিকার একদল নারী, যাদের জীবনে কষ্ট সীমাহীন। বেশিরভাগ ছিল বিবাহিত জীবনে অসুখী, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনে জীবন অতিষ্ট। অনেকেই স্বামীর অকথ্য নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে আসত গিউলিয়ার কাছে। গিউলিয়া তাদের সাহায্য করতে চাইতেন, পরামর্শ দিতেন বিধবা হওয়ার মাধ্যমে সম্পর্ক ছিন্ন করতে। পরে তিনি ইটালির দক্ষিণের বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবসা শুরু করছিলেন, যেখানে একুয়া তোফানা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এটি প্রকাশ্যে বিক্রি হতো ঠিকই, তবে পাউডার মেক-আপ হিসেবে। তাই সহজে বুঝা যেত না। তাছাড়া দাগের জন্য জনপ্রিয় নিরাময়কারী মলম আকারেও পাওয়া যেত। গিউলিয়া তোফানার পরিকল্পনা ছিল দরিদ্র নারীরাও যেন এটি ক্রয় করতে পারে সে অনুসারে তৈরি এবং সুলভ মূল্যে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া। তবে তোফানা শুধুমাত্র সেই মহিলাদের কাছে পণ্য বিক্রয়ে সতর্ক ছিল যাদের সে চেনে, বা যারা অতীত গ্রাহকদের দ্বারা যাচাইকৃত ছিল। অ্যাকোয়া টোফানা পরবর্তীতে লোভনীয় ফেস ক্রিম বা তেল হিসেবে বাজারে ছাড়া হয় যা ইতালীয় নারীরা তাদের যৌবন রক্ষা করতে বা বিধবা হওয়ার মর্যাদা পেতে ব্যবহার করত। এটি বর্ণহীন, স্বাদহীন এবং গন্ধহীন বিষ যা ছোট বোতলে করেও বিক্রি করা হতো। বোতলের গায়ে সেন্ট নিকোলাসের ছবি লেবেল করা, তাই সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। বোতলটি শোভা পেত নারীদের ড্রেসিং টেবিলে, অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রীর মতোই সাজানো থাকত। কে বলবে, এই নান্দনিক শিশি টি কারো মৃত্যুর কারন হতে পারে?

সন্দেহমুক্ত খুন হওয়ার কারনে গিউলিয়ার ব্যবসার প্রচুর উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু একজন গ্রাহকের নির্বুদ্ধিতা গিউলিয়ার জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। সেই মহিলা তার স্বামীর মৃত্যু পরিকল্পনা করতে একোয়া তোফানা কিনেছিল। তার স্বামীর স্যুপে কয়েক ফোঁটা তরল মেশায়, পরে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়লে তার স্বামীকে এটি না খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে এবং ভয়ে গিউলিয়া এবং তার সহযোগীদের সমস্ত কার্যকলাপ বলে দেয়। স্বামী তার স্ত্রীকে জোর করে তোফানা ও বাকীদের পুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলে। সুন্দরী তোফানার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তোফানা এক চার্চের কাছে আশ্রয়ের আবেদন করলে চার্চ তা মঞ্জুর করে নেয়। এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যে, গিউলিয়া তোফানা রোম এবং এর আশেপাশের এলাকার পানিতে তৈরিকৃত একুয়া তোফানা বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। এই গুজবের পর পুলিশ জোর করে চার্চ থেকে তোফানা কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়। শুধুমাত্র রোমে ১৬৩৩-১৬৫১ সাল পর্যন্ত ৬০০ জনেরও বেশি পুরুষকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছিল, যদিও স্বীকারোক্তি বাধ্যতামূলক হওয়ায় এই সংখ্যা কম (বা বেশি) হতে পারে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে তোফানাকে ১৬৫৯ সালে রোমের ক্যাম্পো দে’ ফিওরিতে তার মেয়ে এবং তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কয়েকজন সহযোগীর সাথে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এভাবেই এ নীরব ঘাতকের গল্পের ইতি ঘটে।

Writer,

Somaiya Afrin Eva Khondokar

Intern, Content Writing Department

Requin BD

1 Comments

Write a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *