বিশাল সমুদ্রের দিকে তাকালে আমাদের মনে এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই শান্ত-স্নিগ্ধ সমুদ্রের গভীরেও রয়েছে অনেক জলজ প্রানের অস্তিত্ব, যাদের জীবনযাত্রার কথা শুনে অবাক না হয়ে উপায় নেই। তাহলে চলুন, ঘুরে আসা যাক গভীর সমুদ্রের জগতে।
জম্বি পোকা:
একবার ভাবুন তো, সাগরে কোনো মৃত প্রানীর পচন প্রক্রিয়া কিভাবে হতে পারে? প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ সোডিয়াম ক্লোরাইডের উপস্থিতিতে পচন হওয়া খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। এক্ষেত্রে সমুদ্র তলদেশে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া যায়, যারা তিমির হাড় থেকে শক্তি সঞ্চার করে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় কেমোট্রোফ। কিন্তু এরা তো শুধু সালফাইড সমৃদ্ধ আবরনেই আগ্রহী, তাহলে বাকী হাড় কী করে? এই গুরুত্বপূর্ন কাজটি সম্পন্ন করে জম্বি পোকা, যা Osedax worms নামে পরিচিত! Osedax মানে হাড়খেকো। এদের প্রিয় খাবার তিমির হাড়। সে অনুসারেই এদের নামকরন করা হয়। সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানে এরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোনো তিমি মারা গেলে মৃতদেহ যখন সমুদ্রের তলদেশে আছড়ে পড়ে, তখন এই সমুদ্রপোকারা ছুটে আসে। দেহের মূল জাতীয় অংশ আছে, যেটা ব্যবহার করে তিমির হাড়ের উপর এসে স্থির হয়। তখন পানিতে পাখার মতো এমনভাবে ফুলকা ছড়িয়ে দিয়ে বসে যায়, মনে হয় সমুদ্রে চমৎকার কোনো ফুল ফুটেছে! Osedax এর কোনো মুখ বা পাকস্থলী নেই। মিথোজীবি ব্যাকটেরিয়ারা নিরাপদ আবাসের জন্য Osedax এর উপর নির্ভরশীল। Osedax এদেরকে তিমির দেহে ছড়িয়ে দিয়ে একধরনের এসিড ক্ষরণ করে, ব্যাকটেরিয়ারা এসিডের সাহায্যে ধীরে ধীরে তিমির হাড়কে ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলে। Osedax এর কাজ গুঁড়ো থেকে লিপিড শুষে নেয়া।
ব্ল্যাক সোয়ালোয়ার:
একে বলা হয় “বিষ্ফোরক সমুদ্র দৈত্য”। এরা দৈর্ঘ্যে খুবই ছোট (৬-৮ ইঞ্চি), কিন্তু মুখটা প্রকান্ড। সমুদ্রের প্রানীদের কাছে এ যেন এক দুঃস্বপ্ন। ব্লেডের মতো ধারালো দাঁতের পাশাপাশি শিকার আটকে রাখতে রয়েছে কাঁটাযুক্ত তালু। আবার, আস্ত শিকারকে ধারন করতে ছোট্ট দেহের নিচে রয়েছে বেলুনের মতো পেট। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, দৈর্ঘ্যে প্রায় দ্বিগুণ এবং ভরের দিক থেকে নিজের দশগুণ যেকোনো মাছকে এরা অনায়াসে গিলে ফেলতে পারে!
অবশ্য তাদের এই কার্যক্রমের পেছনে একটা প্রাকৃতিক কারন আছে। সমুদ্রের ব্যাথিপেলাজিক অঞ্চল, যা সমুদ্র পৃষ্ঠতল থেকে ৩,৩০০-১৩,০০০ ফুট নিচে। এই গভীর তলদেশে সচরাচর শিকার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তাই বড় শিকার গিলে ফেলায় অতিরিক্ত শক্তি সংরক্ষন হয়, ফলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা সম্ভব হয়।
কিন্তু সব ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া সুখকর হয় না। কিছু ক্ষেত্রে বড় শিকার তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্যের পরিমান মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় হজম করতে ব্যর্থ হয়। তখন এই খাবার পঁচে গ্যাস তৈরি করে পেটে চাপ সৃষ্টি করে, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বিষ্ফোরিত হতে দেখা যায়। পরে তাদের মৃতদেহ সমুদ্রপৃষ্ঠে ভেসে বেড়ায়। ২০০৭ সালে তেমনি একটি মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল সমুদ্রপৃষ্ঠে। এর পেটে স্নেক ম্যাককেরেল নামে একটি মাছের দেহ পাওয়া গিয়েছিল, যার দৈর্ঘ্য ছিল ৩৪ ইঞ্চি, নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় সাড়ে চারগুণ!
এলিসিয়া ক্লোরোটিকা:
এই জীবটাকে প্রথম দেখাতে বোঝার উপায় নেই এটি গাছ নাকি প্রানী। সম্ভবত একে চলমান পাতা বললেই সবচেয়ে ভালো হয়। প্রানীদের মতো যেমন চলাফেরার ক্ষমতা আছে, তেমনি সালোকসংশ্লেষন প্রক্রিয়ায় নিজেদের খাদ্য উৎপাদনের রয়েছে সক্ষমতা। এদের ক্লোরোপ্লাস্টের উৎস হলো সামুদ্রিক শৈবাল। তবে, খাবারের জন্য এরা শুধু ক্লোরোপ্লাস্টের ওপরেই নির্ভর করে না। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন এরা অন্ধকারেও কোনো খাদ্য গ্রহণ না করে দীর্ঘসময় কাটিয়ে দিতে পারে। কখনও কখনও এদের অলস বলেও আখ্যা দেয়া হয়।
সামুদ্রিক শশা:
শশা তো সবার খুব পরিচিত এক সবজি। কিন্তু সামুদ্রিক শশাও কি তেমন সবজি? উত্তর হলো- এটি একটি সামুদ্রিক প্রানী, সবজির বৈশিষ্ট্যের সাথে কোনো মিল নেই। Echinoderm প্রজাতির এই প্রানীর রয়েছে নানা গুন। ক্যান্সার চিকিৎসা, তেল, ক্রিম এবং প্রসাধনী সামগ্রী বানাতে এর কোনো জুড়ি নেই। যৌন উত্তেজনাবর্ধক ওষুধ তৈরিতেও এর অবদান আছে। সামুদ্রিক শশার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। এটি তার শরীরকে মোটা চাদরের মতো বিছিয়ে চিকন পথে অনায়াসে চলাচল করতে পারে। অনেক সময় কোনো কারন ছাড়াই নিজেকে পুরোপুরি গলিয়ে দেয়, তখন আর আগের অবস্থায় আসতে না পেরে গলতে গলতে মরেই যায়, যেন টারমিনেটর ছবির ভিলেন। এই শ্রেণীভুক্ত প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ১,৭০০।
জেলিফিশ:
নামে ফিশ থাকলেও এটি মাছ নয়। মেরুদন্ডী এই প্রানী নিডারিয়া পর্বের সিফোজোয়া শ্রেনীর অন্তর্গত। ছাতার মতো অংশটি জিলেটিন সমৃদ্ধ। এদের শরীরকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এদের মুখ আর পায়ু একই। অনেক গুলো জেলিফিশ যখন একসাথে সমুদ্রের নিচে চলাচল করে তখন এদের গ্রুপকে “ব্লুম” “সোয়ার্ম” “স্ম্যাক” ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর হলেও কখনও কখনও এটি হতে পারে মৃত্যুর কারন। সাধারন একটি জেলিফিশের টেন্টাকল বা কর্ষিকার কাঁটার খোঁচা ত্বকে লাগলে তিন মিনিটের মাথায় মৃত্যু হতে পারে। জানা যায়, প্রতি বছর ফিলিপাইনে ২০- ৪০ জন মানুষ মারা যাওয়ার একটি কারন জেলিফিশ ।
জোনাকির মতো জ্বলজ্বলে হয়ে থাকার কারণ হিসেবে জেলিফিশের ভেতরে পাওয়া যায় একটি বিশেষ প্রোটিন যার নাম দেওয়া হয় Green Fluorescent Protein (GFP)। সম্পূর্ন শরীরের প্রোটিন এবং স্নায়ুতন্ত্র মাত্র শতকরা ৫ ভাগ জায়গা দখল করে থাকে। বাকি ৯৫ ভাগই পানি থাকে এদের শরীরে। ২০০৭ সালে উটাহ-এ খুঁজে পাওয়া যায় একটি জেলিফিশের ফসিল। এতে জানা যায়, এরা পৃথিবীতে ছিলো ৫০০ মিলিয়ন বছরেরও আগে থেকে ! এক প্রজাতির জেলিফিস আছে যারা নিজেদের রুপান্তর করে, অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হলে একসময় পুনারায় বাচ্চা জেলিফিস হয়ে যায়। এভাবে এ প্রজাতিটি যুগের পর যুগ বেঁচে থাকে, যা আসলেই বিষ্ময়ের ব্যাপার বটে!
Writer,
Somaiya Afrin Eva Khondokar
Intern, Content Writing Department
Requin BD
2 Comments
Fardin Hassan Rocky
April 20, 2023
Darun lekha
Shajuti Kundu
April 30, 2023
Learned a lot of unknown infomation