সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসাক্তি ও অসামাজিকতা
বর্তমানে আমরা আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বসবাস করছি। সব কিছু এখন আমদের হাতের মুঠোয়। এক সময় মানুষ প্রযুক্তি নির্ভর ছিল না। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তি পরিণত হয়েছে মানুষের প্রয়োজন ও চাহিদায়। প্রযুক্তির একটি নির্ভর যোগ্য মাধ্যম হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর যেমন উপকারিতা আছে তেমন অপকারিতাও আছে। বেশি পরিমাণে ব্যবহারের কারণে পরিণত হচ্ছে আসক্তিতে যা যুব সমাজকে নিয়ে যাচ্ছে ধংশের মুখে।
যেহেতু এই প্রযুক্তি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হয় প্রয়োজনে তাহলে এতে আসক্তির কারণ কি?
বাংলাদেশে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখ এবং সর্বোচ্চ ফেসবুক ব্যবহারকারীর দেশ হিসেবে আমাদের অবস্থান দশম স্থানে। যার মধ্যে ইউনিক মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা আনুমানিক ১০ কোটি অর্থাৎ প্রতি দুইজন মোবাইল গ্রাহকের বিপরীতে একজন গ্রাহক ফেসবুক ব্যবহার করে। এবং বাংলাদেশে মোট মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭৫ লাখ ২৭ হাজার। সর্বশেষ ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। আমরা কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বলতে শুধু ফেসবুককেই মনে করে থাকি।
শুধু ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অন্তর্ভুক্ত নয়। আরো কিছু মাধ্যম অন্তভুক্ত আছে। সেগুলো হলঃ- Instagram, Twitter, Snapchat, LinkedIn, Whatsapp, Viber, Messenger, Skype, Wechat, Telegram, Discord, Youtube, google chat.
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকারীদের মধ্যে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় তরুণ ব্যবহারকারীর সংখ্যা তুলনা মুলক বেশি। তাছাড়া করোনা মহামারির সময়ে নারী ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে বেশি। মাদকের চেয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আসক্তি মহামারি আকারে বাড়ছে । এর সঠিক ব্যবহার বা সীমা আমরা ঠিক করতে ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে, সারাদিন প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে করে অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভিডিও , সংবাদ, বন্ধুদের সাথে রাত জেগে চ্যাটিং বেড়ে যাচ্ছে। নেশার মতন ছেয়ে ফেলছে আমাদের। একটা অজানা বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ খুবই সহজাত। তাই প্রযুক্তি বিষয়ে শিশু কিশোরদেরকে এক সময় বাধা নিষেধের মধ্যে রাখা হলেও মহামারি বাস্তবতায় অভিভাবকেরা সন্তানদের হাতে প্রযুক্তি তুলে দিতে বাধ্য হন। তবে অনেক পরিবারে বাবা-মা দুজনেই চাকরিজীবী ফলে, সারাদিন তাদের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে সন্তানের সাথে থাকা সম্ভব হয় না। এজন্য সন্তানের প্রতি নজরদারির বিষয়টিও অনেক সময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও আগে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে ধরনের বন্ধন ছিল, এখন তা নেই৷ যে যার মতো চলছে।
পূর্বে অবসর সময়ে পরিবারের সবাই মিলে একসাথে সময় কাটাত। কিন্তু এখন ঠিক তার উল্টোটা হচ্ছে। সবাই অবসর সময়ে তাদের সময় দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মা-বাবার সন্তান্দের থেকে দূরত্ব বারাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে তাদের আসক্তি। কেউ কাওকে না চিনে না জেনে ভার্চুয়াল ফ্রেন্ডে পরিণত হয়। যা খুবই ভয়ানক। কাওকে সামনা সামনি না দেখে না বুঝে কথা বলা ছবি ভিডিও শেয়ার করা খুবই বিপদজনক। এই মাধ্যমগুলোর প্রবণতা হলো, যে কোনো একটি বিষয়ে নাম লিখে সার্চ দিলেই পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শ’ য়ে শ ‘ য়ে ভিডিও এসে ভরে যায়। এর সহজপ্রাপ্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তির একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যেমন ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধুদের সাথে সহজেই যোগাযোগ করা যায় এবং নতুন সম্পর্ক তৈরি করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ থাকে না। নজরদারিও থাকে না। অল্প খরচে সহজ যোগাযোগ সম্ভব হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মূল যে সমস্যাটা হয় সেটা হলো ‘বিহেভিয়ার এডিকশন’ অর্থাৎ ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি৷ একবার আসক্ত হয়ে পড়লে তখন চাইলেও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না ৷ আর দীর্ঘসময় ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়৷ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহারের ফলে অধিক সময় ব্যয় হয়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং যৌন আলাপচারিতা বেশি হয়। এসব কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিকারগ্রস্ত করে তোলে এবং বিপথে ঠেলে দেয়।
ক্ষতিকর প্রভাব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি বিভিন্নভাবে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। যেমনঃ
সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়
অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তির কারণে মানুষ সৃজনশীল চিন্তার সময় বা সুযোগ পায়না। যার কারণে নষ্ঠ হচ্ছে সৃজনশীলতা।
সময়ের অপচয়
বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়ার কারণে মানুষ তাদের সময়ের অনেকটা অপচয় করছে। যার কারণে সময়ের কাজ সময় মত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত আসক্তির কারণে বুদ্ধিমত্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। আমরা ইদানীংকালে দেখি খুব সহজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়ে এবং নারীরা রাতারাতি বেশ পরিচিতি পাচ্ছেন। এবং অধিকাংশই যে যেই ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ করছেন সেটা নিয়ে আপাতঃ জীবনে অনেক ফ্যান ফলোয়ার তৈরি করছেন। এটি অত্যন্ত ভালো একটি দিক। নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। কিন্তু অপরদিকে এই একটি কাজেই নিজেকে আটকে ফেলছেন তারা। মেধা একটি জায়গায় এসে থেমে যাচ্ছে। এক্সপার্টিজ ডেভেলপ করছে না। প্রতিটি জায়গায় মেধার বিকাশে নানান বিষয়ে জানতে হয়, কাজ করতে হয়। এক বিষয়ে এক নাগাড়ে বেশিদিন কাজ করলে একঘেয়েমি আসে। চিন্তার গভীরতা হ্রাস পায়। যা কিনা মেধার বিকাশে বাধা তৈরি করে। একই জায়গায় মেধা আটকে যায়। দক্ষতা তৈরি হয় না। আমরা ইদানীংকালে দেখি তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা টিকটক আসক্তিতে মেতে থাকছে। এর ফলে আমরা গ্যাং কালচার এর আবির্ভাবও দেখছি। আরেকটি গ্রুপ এসব দেখে দেখেই সময় কাটাচ্ছে। তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। পরীক্ষার ফলাফল আশংকাজনকহারে খারাপ হচ্ছে। ফলে না বুঝেই সুন্দর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে।
শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
অতিরিক্ত আসক্তি বাড়ায় খাবারের প্রতি অনিহা, নিদ্রা হিনতা, মাথা বেথা, মানিসিক চাপ, ব্রেন ও চোখের সমস্যা।
এর সমাধান ও প্রতিকার কি হতে পারে?
তরুণ সমাজকে আসক্তি থেকে বাচাতে হলে তাদের মা বা এবং আশে পাশের মানুষদের থাকতে হবে সচেতন। অতিরিক্ত আসক্তির কুফল, খারাপ দিক তুলে ধরতে হবে। পাশা পাশি সরকারের ও দায়িত্ব আছে । বাড়াতে হবে খেলা-ধুলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্র।
লেখক
সারা সাহরিন মৌমী
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্ট্মেন্ট
রিকুইয়ন বিডি
Write a Comment