মাতৃভাষা দিবস: একুশে ফেব্রুয়ারি, আমাদের অহংকার
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ সমস্ত বাংলাভাষী অঞ্চলে পালিত একটি বিশেষ দিন, যা ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বরে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত যা প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ায় বাংলাভাষী মানুষ আন্দোলনে নেমেছিলেন। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেক তরুণ। তাদের সাহসিকতা ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ওই দিন মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল বাঙালি জাতি। শোকাবহ এ মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গৌরব আর অহংকারের অধ্যায়।
২১ শে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস
১৯৪৭ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরের পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ভাষা–বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে আন্দোলন শুরু হলেও ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটায়।
ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য সাহসী ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজ পথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেক তরুণ। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হয়। না না নির্যাতনের সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজ পথে নেমে আসে। তারা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশগ্রহণ করে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি গুঁড়িয়ে দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।
‘বাংলা ভাষা প্রচলন বিল‘ পাশ হয় ১৯৮৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে। এবং ৮ মার্চ ১৯৮৭ সাল থেকে কার্যকর হয়।
ফেব্রুয়ারি রক্তে রাঙানো ভাষার মাস:
বাংলাদেশ এবং বিশ্বের সব মানুষের কাছেই ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস হিসেবে পরিচিত। যে ভাষার জন্য মানুষ রক্ত দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি সে ভাষা যেন সারা বিশ্বের কাছে সেই মানুষগুলোকেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে এর মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে এবং বাঙ্গালীদের কাছে রক্তে রাঙানো মাতৃভাষা গৌরবময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মূলত বলতে গেলে ভাষার মাধ্যমে বাঙালি জাতির আত্মত্যাগের যাত্রা শুরু হয় এবং এর পথ ধরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্ত এবং জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রিয় বাংলাদেশ ( আমাদের মাতৃভূমি ) স্বাধীনতা লাভ করে। কোন দেশে এমন কোন জাতি পাওয়া যাবে না যে তার মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছে। যা শুধু বাংলার অদম্য সাহসী সন্তানেরাই পেরেছে।
(গীতিকার: সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুরকার: শেখ নজরুল ইসলাম)
“শহীদ তোমাদের রক্তে আমরা লিখি
ইতিহাসের নব অধ্যায়”
একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন:
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের একটি জাতীয় শোক দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি পালনের জন্য বিভিন্ন রীতিনীতি ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সরকারিভাবে:
- রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন।
- জাতীয় সংসদে এক বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
- সারা দেশে সরকারি ভবনগুলোতে আধা নিম্নিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।
- বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গান, কবিতা আবৃত্তি, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি, শোভাযাত্রা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়।
ব্যক্তিগতভাবে:
- সকালে অনেকে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যান এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
- অনেক পরিবার এই দিনটি শোক পালন করে।
- বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এই দিন উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
- টেলিভিশন ও রেডিওতে বিশেষ কার্যক্রম প্রচার করা হয়।
- সামাজিক মাধ্যমে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিভিন্ন পোস্ট ও কমেন্ট শেয়ার করা হয়।
এ সময় আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়।
একুশে বইমেলা:
অমর একুশে গ্রন্থমেলা, যা ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামে পরিচিত, স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলাগুলোর অন্যতম। প্রতি বছর পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে এই মেলা বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
জাতীয় শহীদ মিনার ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বহিঃপ্রাঙ্গণে অবস্থিত। প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এখানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে। এটি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
একুশে ফেব্রুয়ারির অন্যতম শিক্ষা
একুশে ফেব্রুয়ারির অন্যতম শিক্ষা হলো আমাদের মাতৃভাষার প্রতি অটুট ভালোবাসা ও আনুগত্য। এই দিনটি আমাদের:
- ভাষা শহীদদের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের স্মরণ করিয়ে দেয়।
- মাতৃভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলে।
- ভাষাগত বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা যোগায়।
- সকল ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়।
- সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা বহন করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শুধু ভাষার আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয় না, বরং আমাদের জাতীয় ঐক্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্বও বোঝায়। তাছাড়া
- সাহসী, দৃঢ়চেতা ও নীতিবান হতে অনুপ্রাণিত করে।
- অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়।
- সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করার সাহস যোগায়।
- মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধে বিশ্বাসী হতে অনুপ্রাণিত করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি অনুপ্রেরণা, একটি শিক্ষা, একটি জীবনবোধ।
আমাদের সকলের উচিত এই দিনটির মর্মার্থ উপলব্ধি করে আমাদের জীবনে ভাষা ও সংস্কৃতির গুরুত্বকে ধারণ করা।
বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পথচলায় বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে, যা সমাজকে আন্দোলিত করেছিল। কিন্তু ফিরে আসতে হয় এই রক্তে রাঙানো ভাষার মাসে। প্রতি বছর এ দিনটি যে তাৎপর্য বহন করে আনে আমাদের জীবনে, অন্য দিনটি তা করে না। জীবনের অস্তিত্বের সঙ্গে যেন জড়িয়ে গেছে ফেব্রুয়ারি মাস। কিন্তু একুশের শিক্ষা কি আমাদের জীবনে প্রবেশ করেছে? স্বাধীন বাংলাদেশে একুশ শোক বা প্রতিবাদের কথা বলে না। একুশ এখন পরিণত হয়েছে উৎসবে, লক্ষ প্রাণের মুখর জমায়েতে। হারিয়ে যেতে বসেছে মাতৃভাষা বাংলার প্রাধান্য। বিদেশি ভাষা এবং সংস্কৃতি যেন আমাদের ভাষাকে এবং সংস্কৃতিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। বর্তমান সংস্কৃতিতে দেখলে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব । এবং নিজ মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা।
বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বাংলা ভাষা একসময় সাংস্কৃতিক ভাষায় পরিণত হবে, হয়তো হারিয়েও যাবে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকের ছেলেমেয়েই এখন বাংলা পড়তে বা বুঝতে পারে না। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। এই প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রয়োজনে তরুণরা এখন ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করে। এই ভিন্নতা ইংরেজির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পরিবর্তন ঠেকানো সত্যিই এখন কঠিন মনে হচ্ছে, কিন্তু অসম্ভব নয়। ফেব্রুয়ারির ইতিহাস চর্চা ও চিন্তা অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার:
ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের কাছে শুধু একটি মাস নয়, এটি আমাদের জাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।এই মাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের ভাষার জন্য কত মূল্য দিতে হয়েছে।এই মাস আমাদের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরও দৃঢ় করে।আমাদের কর্তব্য আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ভাষার ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়া।
আমাদের মনে রাখতে হবে,
“ভাষা আমাদের জীবনের প্রাণ“
Writer
Sanjida Akter
Intern, Content Writing Department
Requin BD
5 Comments
Carmen
April 15, 2024
Wow, wonderful weblog layout! How long have you been blogging
for? you made running a blog glance easy. The entire look of your website is great, as neatly as the content material!
You can see similar here dobry sklep
kalorifer sobası
September 5, 2024
Your writing is like a breath of fresh air in the often stale world of online content. Your unique perspective and engaging style set you apart from the crowd. Thank you for sharing your talents with us.
kalorifer sobası
September 28, 2024
Bu soba, içindeki yakıtın yanmasıyla oluşan ısıyı doğrudan çevresine yayar ve aynı zamanda suyun ısınmasını sağlar.
KageSaili
November 14, 2024
Two groups were fed a 17 fish oil diet, with or without tamoxifen, and the other two received a 20 corn oil diet, with or without tamoxifen priligy dapoxetine 30mg
KageSaili
November 14, 2024
precio priligy 30 mg A major limitation of both new studies is the use of tumor DNA to determine germline genotype